কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাওবা ও পাপমোচনকারী কিছু আমল পর্ব – ২
লিখেছেন লিখেছেন রাফসান ২২ মার্চ, ২০১৪, ১২:৫২:৪১ রাত
তাওবা দু’প্রকার।
এক. তাওবাতুল ইনাবাহ্:
এ প্রকার তাওবা হলো তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতার কারণে তাকে ভয় করে তার কাছে ফিরে আসা।
দুই: তাওবাতুল ইস্তিজাবা:
এ প্রকার তাওবা হলো আল্লাহ তোমার নিকটে আছে এ কারণেই আল্লাহর নিকট হতে লজ্জিত হয়ে ফিরে আসা।[1]
ইমাম গাযালী (রহ.) তাওবাকে চার প্রকারে বিভক্ত করেন:
এক. বান্দাহ তাওবা করবে এবং স্বীয় তাওবার উপরে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল থাকবে। অন্যায়, ত্রুটি-বিচ্যুতি যা হয়ে গেছে তার সাধ্যমত ক্ষতিপূরণ করবে এবং পরবর্তী সময় তার মনে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদাগত সাধারণ ছোটখাট বিচ্যুতি ব্যতিরেকে কোনো গুনাহ সংঘটনের কল্পনাও উদিত হয় না। এ শ্রেণীর বান্দাহকে সাবিকুম বিল খায়রাতে নামে অভিহিত করা হয়। এ প্রকারের তাওবাকে বলা হয় আত-তাওবাতুন-নাসূহ “নির্ভেজাল-পরিচ্ছন্ন তাওবা” এবং মন ও প্রবৃত্তির এই অবস্থার মান হলো আন নাফসুল মুতমাইন্না( النفس المطمئنة )
দুই. তাওবাকারী প্রধান ও মৌলিক ইবাদতসমূহ যথাযথ আদায় করতে থাকে এবং বড় ধরনের অশ্লীলতা হতে আত্মরক্ষা করে থাকে। কিন্তু তার অবস্থা এই যে, সে সকল গুনাহ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না যা তার পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থানের কারণে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাকে পেয়ে বসে। সে নিজের প্রবৃত্তিকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করতে থাকে এবং অনুতপ্ত হয়। গুনাহর কার্য সম্পাদনের পর পর পুনঃ এ সংকল্প করে যে, সামাজিক ও পরিবেশগত যেই পরিস্থিতির কারণে তার দ্বারা এ গুনাহ সংঘটিত হলো তা হতে সে দূরে অবস্থান করবে এবং নিজেকে রক্ষা করে চলবে। এই প্রকৃতির প্রবৃত্তিকে আন-নাফসুল লাওয়ামা (النفس اللوامة) বলা হয়। তাওবাকারীগণ এই দলভুক্ত সাব্যস্ত হয়ে থাকেন।
তিন. তাওবাকারী তাওবার পরে বেশ দীর্ঘদিন তার উপরে অবিচল থাকে। পরে কোনও পাপ তাকে বশীভুত করে ফেলে এবং সে তাতে লিপ্ত হয়।
চার. পাপ সংঘটনকারী ব্যক্তি তাওবা করার পর পুনরায় বিভিন্ন পাপ কার্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তার মনে তার তাওবার চিন্তা উদিত হয় না এবং তার মনে কোনো প্রকার আক্ষেপ, অনুতাপও জাগ্রত হয় না, বরং সে প্রবৃত্তির কু-চাহিদার গোলামে পরিণত হয়। এ ধরনের প্রবৃত্তিকে আন ‘আন-নাফসুল আম্মারা বিস সূ’ বলা হয়।[2]
ইমাম গাযালী (র)-এর মতে প্রত্যেক মু‘মিনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে (على الفور) ও অবিলম্বে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবায় অভ্যস্ত থাকা ওয়াজিব। কেননা কোনও আদম সন্তানই পাপমুক্ত নয়। তার পাপগুলো ঈমানের জন্য বিধ্বংসী উপকরণরূপে সাব্যস্ত। মানুষ হয়ত তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পাপ সংঘটিত করে কিংবা তার মনঃজগতে পাপের ইচ্ছা জন্ম নেয় কিংবা শয়তানী কুমন্ত্রণা তাকে কখনও না কখনও আল্লাহ তা‘আলার যিকর হতে অমনোযোগী করে ফেলে। এসব হলো নেতিবাচক উৎসের পাপ। এগুলো হতে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হলেও আল্লাহর আহকাম পালন এবং আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বা ও তাঁর গুণাবলী ও ক্রিয়াকর্মের পরিচিতি লাভে অভাব থেকে যেতে পারে। কেননা, কোন মানুষ এ সকল দুর্বলতা ও ত্রুটি হতে মুক্ত ও পবিত্র হওয়া এবং এর কোন একটিও তার মধ্যে না থাকা অকল্পনীয় ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
যে কোনো তাওবা যথার্থ হলে আল্লাহ তা‘আলা তা গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাওবা করাকে পাপ মার্জনার মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং সেই ব্যক্তি তাওবার শর্তাবলী পূরণ করবে তার জন্য তাওবা কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার রয়েছে।যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
‘এবং যেই ব্যক্তি তাওবা করে ও ঈমান এনে পুণ্য কার্য করে আমি তার পাপের জন্য বড়ই ক্ষমাশীল।’ [3]
আল্লাহ নিজেকেই তাওবাকারীদের ক্ষমা করবার ওয়াদা করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করে থাকেন। তিনি বলেন:
“জেনে রাখ, আল্লাহর ওয়াদা সত্য”[4]
এবং তিনি কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
তিনি বলেন:
‘এবং আল্লাহ কখনও তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’[5]
সুতরাং তাওবা কবুল করা শুধু তাঁর মেহেরবানী সূচিত ওয়াদা পূর্ণ করার ব্যাপার।
কোন তাওবাহ কাজে লাগে আর কোনটি কাজে লাগে না?
তাওবার শর্ত তিনটি। তাৎক্ষণিকভাবে গোনাহ ছেড়ে দেওয়া, ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা, অতীত কর্মে অনুশোচনা করা। এ জাতীয় তাওবাই মূলত ‘তাওবাতুন নাসূহ’।
হাসান আল-বাসরী (রহ.) বলেন:
‘তাওবায়ে নাসূহ হলো, হৃদয়ে অনুশোচনার জবাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে গোনাহ পরিত্যাগ করা। ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় প্রতিক্ষা করা।’[6]
ইমাম বাগভী (র) বলেন: উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, উবাই রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:[7]
‘তাওবায়ে নাসূহ হলো তাওবা করার পর গোনাহের দিকে প্রত্যাবর্তন না করা।
যথাসময়ে তাওবা না করে মুমূর্ষু অবস্থায় তাওবা করলে তা কোনো কাজে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন:
‘তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দকাজ করে এবং তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে, আমি এখন তাওবা করছি এবং তাওবা তাদের জন্যও নয়, যারা মারা যায় কাফির অবস্থায়। এরাই তারা, যাদের জন্য আমি মর্মন্তদ শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।’[8]
খালিস অন্তঃকরণে তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবুল করেন এবং জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তুমি যদি এত অধিক পরিমাণ পাপ কাজ করে থাক যে, তা আকাশ সমান উঁচু হয়, এরপর অনুতাপের সাথে ‘তাওবা’ কর, তবুও তোমার তাওবা কবুল হবে, প্রত্যাখ্যাত হবে না।[9]
এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতসমূহের মধ্য থেকে একটি নেয়ামত এই যে, তিনি তওবার দরজা বন্ধ করেন নি। বরং জীবনের প্রতি মুহূর্তেই তওবার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তাকে সর্বদা সন্দেহাতীতভাবে তাওবার প্রতি গুরুত্ববহ থাকতে আদেশ করেছেন।
তওবার প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার উৎসাহ প্রদানের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তিনি তওবাকারীর গোনাহগুলোকে নেকী দ্বারা রূপান্তর করে দেবেন। আল্লাহ বলেন:
“কিন্তু যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, এদের গোনাহগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা নেকী দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[10]
অপর এক আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
“আপনি বলে দিন! আত্মার প্রতি যুলুমকারী আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহর নেয়ামত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সকল গোনাহ মোচনকারী। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[11]
এদিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবা দ্বারা যারপরনাই আনন্দিত হন। যেমনটি হাদীসে এসেছে: ‘খাদেমুন্নবী’ আবু হামযা আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবা দ্বারা অতখানি খুশী হন যতখানি খুশী হয় বিজন মরুতে হারিয়ে ফেলা উটের মালিক তার উট প্রাপ্তিতে।”[12]
কাজেই কোনও মুসলিম যখন গোনাহে লিপ্ত হয় তখন তার মাটিতে উট পাখির মত কপাল না ঠুকে আল্লাহর কাছে নিজের কৃত গোনাহর স্বীকৃতি দেয়া দরকার। অনুতপ্ত হওয়া দরকার। এর এ কথাটিও মনে রাখা দরকার যে, গোনাহকে তুচ্ছ করার দ্বারা গোনাহকারীর কোনও উপকার হয় না এবং তার গোনাহ সামান্য হালকাও হয় না বরং তা আরো বাড়তে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র নামসমূহের অন্তত দু‘টি গুণবাচক নাম বান্দাহর গোনাহ মাফ করার বৈশিষ্ট্য হিসাবে বরাদ্দ রেখেছেন।
তিনি বলেন,
“তারা কী জানে না, আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের তওবা গ্রহণ করে থাকেন।”[13]
আল্লাহ আরো বলেন:
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না”[14]
আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই তাঁর উচ্চ মহান নামাবলি ও সুস্থ-সুমহান গুণাবলীর বদৌলতে যে, তিনি যেন আমাদের তওবা কবুল করেন, আমৃত্যু এর উপর দৃঢ়পদ রাখেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও উত্তরদাতা।
ইমাম আহমদ প্রখ্যাত সাহাবী আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু- থেকে বর্ণনা করেন:
“নিশ্চয় তোমরা অচিরেই এমন আমল করবে যা তোমাদের চোখে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম ও হালকা মনে হবে অথচ রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগে আমরা একে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম।”[15]
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা আমরা আজকালকার দিনের গোনাহকে হালকা অনুভব ও এর প্রতি বেপরোয়া মনোভাবের কথা অবগত হতে পারলাম। মানুষ গোনাহকে হালকা মনে করতে করতে এক সময় কবিরা গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ গোনাহের অনুভূতি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। একথা স্মরণযোগ্য যে, অনুতাপ হচ্ছে তওবার প্রধান অঙ্গ ও শর্ত। অনেক তওবাকারীর জীবনে এ দিকটির অনুপস্থিতি দেখা যায়। এমনিভাবে গোনাহের প্রতি এ ধরনের উদাসীনতা মানুষকে গোনাহের প্রতি আকর্ষিত ও অভ্যস্ত করে তোলে। এর থেকে তার পরিত্রাণের কোনও সুযোগ থাকে না; যদিও আল্লাহ তা‘আলা এর থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা রেখেছিলেন তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে। সহীহ হাদীসে উল্লেখ আছে, গোনাহ লেখক বাম কাঁধের ফেরেশতা। বান্দার গোনাহ অন্তত গোনাহ করার পর থেকে ৬ ঘন্টা পর্যন্ত লেখা থেকে বিরত থাকে। এই ৬ ঘন্টার মধ্যে বান্দা যদি অনুতপ্ত হয় ও ইস্তেগফার করে তাহলে ওই গোনাহ মুছে দেন অন্যথা আমলনামায় গোনাহ লেখা হতে থাকে।[16]
মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ তওবা ও ইস্তেগফারের আবশ্যকতার উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। ইমাম কুরতুবী (রহ) বলেন, মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, মুমিন বান্দার উপর তওবা করা ফরয। কাজেই সকলের উপর এ ফরয বর্তাবে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“কোনো বান্দা যখন গোনাহ করে, তারপর সুন্দররূপে উযু করে দু‘রাকাত সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দেন।”[17]
[1] কাশশাফু ইসতিলাহাতিল ফুনুন, ১ম খন্ড, পৃ. ২১৯-২২০।
[2] সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ, ১২শ খন্ড (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪১৩ হি./১৯৪২ খ্রি.), পৃ. ৮২।
[3]. সূরা ত্বাহা: ৮২।
[4]. সূরা ইউনুস: ৫৫।
[5] সূরা আল-হাজ্জ, ২২: ৪৭।
[6] আল-আদাবুশ-শার‘ঈয়্যাহ, ১ম খন্ড, পৃ. ১১৬।
[7] পূর্বোক্ত।
[8] সূরা আন-নিসা, ৪:১৮।
[9] তিরমিযী: ৩৫৪০।
[10] সূরা আল-ফুরকান: ৬৯।
[11] সূরা আয-যুমার: ৫৩।
[12] বুখারী: ৬৩০৯; মুসলিম: ২৭৪৭।
[13] সূরা আত-তাওবাহ: ১০৪।
[14] সূরা আয-যুমার: ৫৪।
[15] মুসনাদে আহমাদ ৩/৩।
[16] সুলায়মান ইবন আহমদ আত তাবারানীর আল-মুজামুল কাবীর, হাদীস নং: ২০৯৭। আর দেখুন, সিলসিলা সহীহা: ১২০৯।
[17] মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৫৭৩৮।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
৯২৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন